• বুধবার, ২৮ মে ২০২৫, ০৮:৫৩ অপরাহ্ন
  • [gtranslate]

দিনাজপুরে মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষি শ্রমিকরা

বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি / ৪০ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

নারী শ্রমিক ও চাষির। দিনাজপুরের রোদ-ঝড় ও বৃষ্টিসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চলতি মৌসুমে বোরো ধানের জমিতে ধান কাঁটার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন তারা । কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিই সাধারণ কৃষি শ্রমিকরা। যারা কৃষির মেরুদন্ড। ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি ভূমিতে সব ধরনের শ্রমিকরাই বঞ্চনার শিকার হয়।

দুর্বল এবং অসহায় অংশ হিসেবে নারীরা হয় একেবারে বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট। অথচ অপরিহার্য এই শ্রম বিনিয়োগে নারী-পুরুষে কোন তারতম্য নেই। অর্থাৎ পুরুষেরা যে পরিমাণ এবং যে ধরনের শ্রম দেয় সেখানে নারীদের বেলায়ও একই রকমের। অর্থাৎ সময় এবং কাজের ধরনের বেলায় কোন ধরনের পার্থক্য নেই। কিন্তু মজুরির বেলায় নারী শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়।

কৃষি উৎপাদনে ফসলের বীজ বপন করা, আগাছা পরিষ্কার করা, ধান বাছাই করা, কাটা সবশেষে গোলার মজুত করা পর্যন্ত সব ধরনের কাজ নারী শ্রমিকরা নির্দ্বিধায় করতে আপত্তি করে না। কিন্তু শ্রম মজুরির বেলায় পুরুষের সঙ্গে তাদের যে ফারাক সেটাই তাদের ক্ষুব্ধ করে, আহত করে করে তুলছে।

সরজমিনে দেখা যায়, ধানের গন্ধে ঘাম ঝরানো নারীরা প্রায় ৯ বিঘা জমির ধান কাটছেন ২০ জন নারী শ্রমিক সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের দেয়াল পেরিয়ে কৃষি শ্রমে নারীদের সাহসী পদচারনা। উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়নে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে বোরো ধানের জমিতে ধান কাঁটা মাড়াই করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বোরো চাষিরা।

প্রচন্ড রোদ, মাথায় ধানের আঁটি। ধানের গন্ধমাখা জমির ভেতর দিয়ে হেঁটে চলছেন নারী শ্রমিকরা। পায়ে কাঁদা, গায়ে ঘাম- তবুও চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ নেই । বরং প্রতিফলিত হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, দায়িত্ববোধ আর পরিশ্রমের গৌরব। যান্ত্রিকতার এই যুগেও দেশের অনেক প্রান্তে নারীর কাঁধেই টিকে আছে কৃষিখাতের বড় একটি অংশ।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সুজালপুর ইউনিয়নের বর্ষা গ্রামের বর্ষা কান্দর এলাকায় ২৪ জন শ্রমিকের একটি দল ৯ বিঘা জমির ধান কাটছেন চুক্তিভিত্তিকভাবে। এই দলের ২০ জনই নারী। তারা এসেছেন পাশের নিজপাড়া ইউনিয়নের দামাইক্ষেত্র গ্রাম থেকে।

দলের নেতৃত্বে থাকা সুমি রানী (৩৮) জানান, প্রতি বিঘা জমির ধান কাটার মজুরি ফসল ভেদে ৪২০০ থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। গড়ে দিনে তাঁরা ৩ বিঘা জমির ধান কাটতে পারেন। সব কাজ শেষ করতে তিনদিনের মতো লাগবে বলে আশা করছেন। সবমিলিয়ে চুক্তিভিত্তিক মোট আয় প্রায় ৩৮ হাজার টাকার মতো।

প্রতি জনের গড় মজুরি দাঁড়াবে প্রায় ৫৩৭ টাকা। যাতায়াত ও খাবারের খরচ বাদ দিলে হাতে থাকে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকার মতো। ৪০ বছর বয়সী মনিষা রানী বলেন,পরিবারে পাঁচজন সদস্য। স্বামী দিনমজুর। জমিজমা কিছুই নেই, শুধু বসতভিটা। ধান, ভুট্রা, আলুসহ সব ধরনের কৃষিকাজ করি সংসার চালাতে।

অন্য শ্রমিক শোভা রানী (৪০) বলেন, আমাদের স্বমীরা দিনমজুর। আয় কম খরচ বেশি। যন্ত্রের কারণে অনেক সময় কাজ থাকেনা , তবে যেসব জমিতে যন্ত্র ঢুকতে পারেনা , সেসব জায়গায় আমরা দল বেঁধে কাজের সুযোগ পাই। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ জন পর্যন্ত হয়ে থাকে। তার বেশীর ভাগই নারী।

ধান ক্ষেতের মালিক কৃষক জাহিদুল ইসলাম জানান, জমিটি মেইন রোড থেকে অনেক ভিতরে , রাস্তা সরু ও কাচা হওয়ায় হারভেস্টর মেশিন দিয়ে ধান কাটা সম্ভব নয়। তাই শ্রমিক নিয়েছি । মেশিনে কাটলে খরচ কম হতো – প্রতি বিঘায় খরচ ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকার মতো। কিন্তু যন্ত্র না পৌছাতে পারায় শ্রমিকই ভরসা।

স্থানীয় সমাজ সেবক, মোহাম্মদ আলী বলেন,এই নারীরা শুধু শ্রমিক নয়, তাঁরা কৃষি অর্থনীতির নীরব সৈনিক। তাদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে আরও প্রশিক্ষণ ও সহয়োগিতা প্রয়োজন।

বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, বীরগঞ্জের নারীরা এখন কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে ধান রোপন, কর্তন, মাড়াই ও সংরক্ষণে। তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও সহযোগীতা দেওয়া হচ্ছে। যাতে করে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহন বৃদ্ধি পায়।

বর্ষা কান্দরের এই দৃশ্য শুধু একটি গ্রামীন কর্মযজ্ঞ নয় বরং এটি সমাজ পরিবর্তনের এক নিঃশব্দ বার্তা। বাংলাদেশের নারী আর গৃহকোনে সীমাবদ্ধ নন- তাঁরা মাঠেও দক্ষ, পরিশ্রমী ও দায়িত্ববান। যন্ত্রায়নের যুগেও তাঁদের প্রয়োজনীয়তা অক্ষুন্ন- বরং আরও বেড়েছে। তাঁদের অবদান দেশের কৃষি ও অর্থনীতিতে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলছে।

Facebook Comments Box


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
bdit.com.bd
error: Content is protected !!